মহান ভাষা আন্দোলনে খান মুহাম্মদ সালেক স্যার ও দীপ্তিময় আরমানিটোলা স্কুল
মায়ের ভাষার দাবীতে ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন হলো তার ঢেউ আন্দোলিত করেছিল আমাদের লাল দালানকেও। বায়ান্নর উত্তাল সময়ে আমাদের আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রখ্যাত শামসুদ্দিন স্যার। প্রথিতযশা শিক্ষকমন্ডলীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন, শ্রী বীরেম চক্রবর্তী, জনাব কামরুদ্দিন, শ্রী নগেন দাশ, জনাব বজলুর রশিদ, জনাব ইসহাক, জনাব আব্দুল গনি, বাবু মনীন্দ্র সেন, বাবু ভূপেন কর, বাবু নিত্যলাল বসাক, বাবু অনীল চক্রবর্তী প্রমুখ। এই মানুষ গড়ার দক্ষ কারিগরদের ভিড়ে একজন ছিলেন খান মুহাম্মদ সালেক স্যার। প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার অধিকারী সালেক স্যার আমাদের স্কুলে যোগ দেন ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪ সালে। সেই মোহময় যোগদানের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে স্যার বলেন,"পহেলা ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ থেকে আমি রীতিমতো বেকার। বিগত ডিসেম্বরে কলকাতা জনশিক্ষা পরিচালকের দফতরে অনুষ্ঠিত সাক্ষাৎকারের ফলাফলের অপেক্ষায় দিন গুনছি। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে গেলাম নিয়োগ পত্র। নিয়োগ পত্র খুলে দেখি, একী! এ যে স্বপ্নময় আরমানিটোলা স্কুল।আমি তো আনন্দে অধীর।একেবারে আত্মহারা। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল রক্তিম বর্ণের সুরম্য দ্বিতল অট্টালিকার মনোহর মানচিত্র।"
ফিটফাট হয়ে বসুন প্রিয় বাংলাদেশের মানচিত্র বিনির্মানের প্রথম পদক্ষেপ মহান ভাষা আন্দোলনে আমাদের স্কুলের ভূমিকার গল্প বলছি শুনুন। স্কুলে যোগদানের আট বছর অতিক্রান্ত হয়েছে,বায়ান্ন সাল এসেছে। জানুয়ারির শুরু থেকেই সালেক স্যারের মননে মায়ের ভাষা বাংলার মান রক্ষার তাগিদ। সেই মননের অনুভব ছড়িয়ে গেল তার ছাত্রদের মধ্যেও। তখন তিনি ছিলেন অষ্টম শ্রেণির শ্রেণিশিক্ষক। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে একদিন, প্রধান শিক্ষক শামসুদ্দিন স্যার - সালেক স্যারকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে বললেন, "আপনার হিতৈষি কয়েকজন এসে বলে গেছেন, সালেক স্যারকে একটু সমঝে চলতে বলবেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের কথা বলে ছাত্রদের যেভাবে উত্তেজিত করছেন তাতে করে তিনি নির্ঘাত গ্রেফতার হয়ে যাবেন।
যে গ্রেফতারের আতংক ছিল তা সত্যি সত্যি ঘটে গেল। তবে সেই আতংক ঘটনা শিক্ষকের ক্ষেত্রে ঘটলনা। ঘটল তার শ্রেণির ছাত্রদের ক্ষেত্রে। সেই ওয়ার্নিংয়ের দু'একদিনের ব্যবধানে একদিন অষ্টম শ্রেণির অধিকাংশ ছাত্র গ্রেফতার হলো। বিকেল পর্যন্ত তাদের আটকে রেখে সন্ধ্যা নাগাদ কুর্মিটোলায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল পুলিশ। সেকালে কুর্মিটোলা ছিল বহুত দূর। ভয়ে আতংকে বিপর্যস্ত ছাত্ররা বিধ্বস্ত হয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরল। শুধু ফিরলনা একজন। তার নাম হাফিজুর রহমান। সালেক স্যারের শ্রেণির সবচেয়ে কনিষ্ঠ ছাত্র ছিল সে কিন্তু ছিল বহুত তেজি। সে সরাসরি পুলিশকে চার্চ করল কেন তাদের গ্রেফতার করা হল। যখন পুলিশ বলল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অপরাধে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তখন সে বলল, ও এই কথা। যেই বলা সেই কাজ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শ্লোগানে মুখোরিত করল কোতোয়ালি থানা প্রাংগণ, "রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই।" এই শ্লোগানের অপরাধে ছোট শিশুটিও পাকিস্তানি তল্পিবাহকদের চক্ষুশূলে পরিণত হল। হাফিজুর রহমানকে ঢাকা জেলে বন্দি করে রাখল একুশ দিন। একুশ দিন জেল খাটা ভাষা সৈনিক হাফিজুর রহমান ও তার আদর্শস্থানীয় শিক্ষক খান মুহাম্মদ সালেক স্যার আজও আমাদের অদমনীয় প্রেরণা। একুশ মানে মাথা নত না করা।
পুনশ্চ : পরবর্তিতে খান মুহাম্মদ সালেক স্যার আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন।১৯৬১ সালে যখন গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তিনি প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন এবং নবীন স্কুলটিকে আরমানিটোলা স্কুলের আদলে গড়ে তুলে নাম যশ খ্যাতি এনে দেন। মহান ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য খান মুহাম্মদ সালেক স্যার ১৯৯২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। আমাদের মেধাবী ও তেজস্বী অগ্রজ হাফিজুর রহমান পরবর্তি জীবনে সিএসপি পদ অলংকৃত করেন। কীর্তিমান ছাত্র-শিক্ষক দুজনের কেউই আজ পৃথিবীতে নেই। আমি মহান আল্লাহর কাছে তাদের জন্য জান্নাতুল ফেরদৌসের প্রার্থনা জানাচ্ছি।
No comments:
Post a Comment