![]() |
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে স্যার যদুনাথ সরকার, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চ্যান্সেলর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ভাইস চ্যান্সেলর এ এফ রহমান (কার্জন হল-১৯৩৬) |
আমাদের স্কুলে শরৎচন্দ্রের একদিন
সামনে ঢাকার বৃক্ষ জগতের ক্যাসানোভা কৃষ্ণচুড়া আচ্ছাদিত বিশালকায় খেলার মাঠ। উত্তর -পশ্চিম কোনে মনোলোভা তারা মসজিদ। মসজিদ সংলগ্ন গেট পেরোলেই সবুজের সমারোহের বুক চিরে কালো মসৃন পিচঢালা পথ গিয়ে মিশেছে জ্ঞানরাজ্য আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের অজস্র রক্তিম রুবি খচিত লাল সিংহাসনে। বিশ্বখ্যাত স্থপতি এফ আর খান,জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি , অম্লান দত্ত, ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অশোক মিত্র এরকম অজস্র রুবির ভীড়ে একটি নাম সৈয়দ আলী আহসান, বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক। ১৯৩৭ ব্যাচের কৃতি ছাত্র ১৯৮৫ সালে এলেন স্কুল প্রাংগনে আমাদের এনুয়াল স্পোর্টস ইভেন্টে প্রধান অতিথি হয়ে। সেদিন ছিল মধ্য জানুয়ারীর এক সোমবার, তিনি প্রধান অতিথির বক্তৃতায় দাড়িয়ে বললেন, "আমি আমার স্কুলকে প্রতিদিন স্মরণ করি"। মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে চুপচাপ শুনছিলাম, কি বলব, আজ আমরাওতো প্রতিদিন স্মরণ করি আমাদের প্রিয় স্কুলকে। সেদিনের সাথে আজকের দিনের সাত সমুদ্র তের নদীর ব্যবধান রচিত হয়েছে। স্মৃতির খেয়ায় ভেসে একটু একটু করে সেই ব্যবধান ঘোচাচছি আমরা। কালের স্রোতে ভেসে আসা সৈয়দ আলী আহসান স্যারের সেদিনকার স্কুল স্মৃতির ঝাপিঁ খুলে বসা কথামালা কত বছর পরে আমার কানে প্রতিদধনি হয়ে ফিরে এল। আমার মনে পড়ে সেদিন তিনি বিশেষভাবে বাংলা ভাষার অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৯৩৬ সালে আমাদের আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাই স্কুল ভ্রমনের গল্প বলেছিলেন। আজ কত বছর পর আমি আপনাদের আবার সেই গল্পের আবেশে মোহাবিষ্ট করতে চলেছি।
সৈয়দ আলী আহসান স্যার বলছেন, "আমাদের স্কুল জীবনের একটি জমকালো স্মৃতি শরৎচন্দ্র চট্টাপাধ্যায়কে কাছ থেকে চাক্ষুষ করা"। ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে স্যার যদুনাথ সরকার ও শরৎচন্দ্র চট্টাপোধ্যায়কে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রীতে সম্মানিত করা হয়েছিল। শরৎচন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া ডক্টরেট অব লিটারেচার উপাধি পেয়ে দারুণ আনন্দিত হয়েছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার মনের একটি দীর্ঘস্থায়ী বেদনার উপশম করেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যে মর্ম বেদনা দিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাতে ভালোবাসার প্রলেপ দিল। স্যার যদুনাথ সরকার , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার এক সাথে এলেন আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে ১৮ জুলাইয়ের দ্বিপ্রহরে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী Krahanchy গাড়িতে চেপে। গলায় ফুলের মালা জড়িয়ে গুণগ্রাহীদের ভীড় গলিয়ে কথার যাদুকর এলেন আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে।আমাদের স্কুলের দোতলায় অবস্থিত তদানীন্তন ঢাকা ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ খান বাহাদুর আবদুর রহমান খানের আতিথেয়তায় কিছু সময় অতিবাহিত করে শরৎচন্দ্র তার তিন সংগী সমভিব্যাহারে এলেন আমাদের শ্রেণী কক্ষে। আমরা তখন দশম শ্রেনীর ছাত্র।আমাদের ভূগোল পড়াচ্ছিলেন শামসুদ্দিন স্যার । ব্ল্যাকবোর্ডের উপর ভারতবর্ষের একটি রিলিফ ম্যাপ টাঙ্গানো ছিল। রিলিফ ম্যাপে একটি দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা থাকেনা, দৃশ্যমান থাকে পাহাড়-পর্বত, নদীনালার অবস্থান। বিভিন্ন রং ব্যবহার করে ভূভাগের উঁচুনিচু অবস্থা এবং স্রোতধারা দেখানো হয়। আমাদের শ্রেনী কক্ষে প্রবেশ করেই সবার আগে ম্যাপটি শরৎচন্দ্রের চোখে পড়লো, তিনি শামসুদ্দিন স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন- এটা কি হে? স্যার বললেন, `এটা ভারতবর্ষের ম্যাপ । শরৎচন্দ্র আবার জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিরকম ভারতবর্ষের ম্যাপ? এরকম এবড়ো থেবড়ো কেন? শামসুদ্দিন স্যার বললেন, এটা রিলিফ ম্যাপ। শরৎচন্দ্র বললেন, রিলিফ? রিলিফ আবার কি? তুমি তো ব্যাপারটা আরো ঘুরিয়ে দিলে হে। তুমি কি ছাত্রদের মাথা এভাবে ঘুরিয়ে দাও? আমরা ক্লাসের ছাত্ররা তাদের বাক্যালাপ খুব উপভোগ করেছিলাম।" মজলিসী শরৎচন্দ্র মজা করলেন আমাদের চার শ্রেণী জুনিয়র অশোক মিত্রদের ক্লাসেও। অশোক মিত্র একজন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ এবং মার্কসবাদী রাজনীতিবিদ। তিনি ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী এবং রাজ্যসভার সদস্য হন। সেদিন ট্রেনিং কলেজের একজন অধ্যাপক অশোক মিত্রদের পড়াচ্ছিলেন হজসনের Time you old gypsy man কবিতাটি। শরৎচন্দ্র অধ্যাপকের কাছ থেকে পাঠ্য বিষয় জেনে নিয়ে ছাত্রদের বললেন,”তোমাদের কবিতার সময় বুড়ো আমার চাইতেও বুড়ো নাকি হে।আমি হলুম গিয়ে ন্যাড়া বুড়ো। অনেক অনেক দিন আগে এই ন্যাড়া বুড়ো তোমাদের মত নবীন বুড়ো ছিলেম। আমার বাবা আমাকে পিয়ারী পন্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দিলেন, কিন্তু আমি নিত্য পড়া কামাই করি দেখে বাবা বললেন, “ন্যাড়া, পাঠশালায় যাস না কেন?” আমি বললুম, ভাল লাগে না যে। বাবা বললেন, ”না পড়লে বড় হবি কি করে?” আমি জিজ্ঞাসিলাম, পড়লে বুঝি বড় হওয়া যায়? বাবা আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ”হ্যাঁ রে, হ্যাঁ”। তার পরে আমি পাঠশালায় গেলুম। তাতে গোল বাড়ল। দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ করে তুললাম পিয়ারী পণ্ডিতকে। এক দিন পাঠশালায় নতুন ছেলে ভর্তি হয়েছে। আমি তার কাছে জানতে চাইলুম সে লিখতে পারে কি না। জবাবে ‘না’ শুনে ‘তবে দে, তোর লেখা লিখে দিই’ বলে স্লেটে বড় বড় অক্ষরে লিখলুম,”তুই একটা গাধা’। তার পর সে হঠাৎ হেঁচে তন্দ্রাচ্ছন্ন পণ্ডিতকে জাগিয়ে তুলল। তাঁর চোখ পড়ল নতুন ছেলেটির উপরে, ‘‘কী ছাঁদের আঁক কচ্ছিস দেখি।’’ স্লেট হাতে নিয়েই চিল-চিৎকার, ‘‘বলি, হ্যাঁ রে ছুঁচোমুখো—‘‘তুই একটা গাধা’’ তার মানে কি রে উল্লুক? কেন লিখেছিস জবাব দে।’’ ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে আমার দিকে তাকায়। আমবাগানে পলায়ন বিনা আমার আর কোনও উপায় রইল না। প্রানবন্ত শরৎচন্দ্রের আমাদের স্কুল ভ্রমনের স্মৃতি আজও জীবন্ত মনে হয় আমার কাছে।
No comments:
Post a Comment